রমজান মাসে ডায়াবেটিস

শেয়ার করুন

সুচিপত্র

পবিত্র রমজানে স্বাভাবিকভাবেই পরির্বতন হবে ওষুধ বা ইনসুলিন নেয়ার মাত্রা ও সময়সূচি। এ সময় আপনার শরীরের ক্যালরি এবং ওষুধের মধ্যে সামঞ্জস্যহীনতা দেখা দিতে পারে। সেজন্য আপনার রক্তে শর্করার মাত্রা হঠাৎ বেড়ে আবার কমে যেতে পারে। তাই রমজান মাসে রোজা রাখার জন্য ডায়াবেটিসের রোগীদের দরকার পূর্ব-প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ। রমজান মাসে খাদ্য গ্রহণ, ব্যায়াম ও ওষুধের পরিবর্তন বিষয়ে আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন ও আমেরিকান ডায়াবেটিস অ্যাসোসিয়েশনের সুনির্দিষ্ট কিছু নিয়ম রয়েছে। তার ওপর ভিত্তি করে একজন রোগী তাঁর রক্তে শর্করার পরিমাণ ও ডায়াবেটিসজনিত জটিলতা ইত্যাদি বিবেচনা করে নতুন নিয়মসূচির জন্য আগে থেকেই চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে নেবেন।

রমজান মাসে মুসলিমগণের খাদ্যাভ্যাসে হঠাৎ করে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। ডায়াবেটিস রোগ এবং এর চিকিৎসা যেহেতু খাদ্য গ্রহণের সাথে সম্পর্কযুক্ত, তাই রমজান মাসে ডায়াবেটিস রোগীদের পরিবর্তিত খাদ্যাভ্যাসের সাথে মিলিয়ে চিকিৎসায় বিশেষ পন্থা অবলম্বন করতে হয়।

সর্বপ্রথম প্রস্তুতি হিসেবে জেনে নেওয়া উচিত ডায়াবেটিসে আক্রন্ত রোগীর শরীর রোজা রাখার জন্য উপযুক্ত কি না। যদি তার শরীরে শর্করার মাত্রা খুবই অনিয়ন্ত্রিত থাকে, অর্থাৎ তিন মাসের মধ্যে মারাত্মক হাইপোগ্লাইসেমিয়া বা (রক্তে গ্লুকোজ কমে যাওয়া), কিটোঅ্যাসিডোসিস বা শর্করার মারাত্মক আধিক্য ইত্যাদি থাকে তাহলে রোজা রাখা উচিত নয়। ডায়াবেটিস ছাড়াও অন্যান্য শারীরিক সমস্যা যেমন যকৃতের সমস্যা, হূদেরাগ ও কিডনি সংক্রমণ ইত্যাদিতে আক্রান্ত হন, তহলেও আপনার রোজা না রাখাই ভালো। এই তালিকায় গর্ভবতী ডায়াবেটিস রোগী, অত্যধিক বয়স্ক রোগী ও যাঁরা ডায়ালাইসিস নিচ্ছেন, তাঁরাও পড়বেন।

রমজানের খাদ্যাভ্যাস ও ব্যায়াম:

একজন ডায়াবেটিসের রোগী রমজানের আগে যে পরিমাণ ক্যালরি গ্রহণ করতেন, রমজান মাসেও তার হেরফের হবে না, কেবল এর সময়সূচি ও উপাদান পরিবর্তিত হতে পারে। ইফতারির সময় ও পরে হঠাৎ করে বেশি পরিমাণে খাদ্য গ্রহণ না করা, চিনি, মিষ্টি ও ভাজাপোড়া খাবার থেকে বিরত থাকা এবং পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের অভ্যাসের মাধ্যমে এ সময় অনেকটাই সুস্থ থাকা যায়।

সেহরীর খাদ্য:

যথা সম্ভব দেরীতে সেহেরী গ্রহন করুন। জটিল শর্করা গ্রহন করতে চেষ্টা করুন। যেমনঃ লাল আটা, লাল চালের ভাত, বার্লি, আটার রুটি, জই, সুজি, খেজুর, বাদাম, মটরশুঁটি, ডাল, পাকা কলা এবং আঁশ যুক্ত খাদ্যঃ ভুষি, শস্য ও বীজ, সবুজ শাক-সবজি, কাজু বাদাম ইত্যাদি।

ইফতারের খাদ্য:

যথা সম্ভব দ্রুত ইফতার করুন। সাধারন খাদ্য গ্রহন করুন। যেমনঃ ভাত বা ভাত জাতীয় খাদ্য, খেজুর, ফলের রস, পানি। বর্জন করুনঃ ভাজা-পোড়া খাদ্য, কাবাব, বেগুনি, পেঁয়াজু, চর্বি ও তৈলাক্ত খাদ্য, চিনি ও গুড়ের তৈরী খাদ্য, জিলাপি, লাড্ডু, শরবত, হালুয়া, কেক, আলুনি, চা, সফট ড্রিংকস ইত্যাদি। ভাজাপোড়ায় কেবল ওজনই বাড়াবে না, রক্তে চর্বি বাড়িয়ে দেবে, পেটে বদহজম ও গ্যাস সৃষ্টি করবে।

পানি পান:

ইফতার থেকে সেহেরী পর্যন্ত সময়ে মোটামুটি ৮ গ্লাস বা ২ লিটার পানিই যথেষ্ট। চা, কফি, সফট ড্রিঙ্কস এড়িয়ে চলুন।

গরম কালে প্রচুর ঘাম হয় এবং গরম কালের রমজানে রোজাদারের পানি শুন্যতা দেখা দিতে পারে। তাই রোজাদার ডায়াবেটিস রোগীরা ইফতারের সময় থেকে সেহেরী পর্যন্ত প্রচুর পানি পান করবেন। তবে, যেসব ডায়াবেটিস রোগীর কিডনীর কার্যক্রমে কোন জটিলতা আছে তাদের চিকিৎসকের নির্দেশ মত পানি পান করতে হবে।

ইফতারির সময় সুষম ও পুষ্টিকর পরিমিত আহার, রাত ১০টার দিকে রুটি বা হালকা ডিনার এবং অবশ্যই শেষ রাতে ভাত বা রুটিসহযোগে যথেষ্ট পরিমাণে আমিষ ও তরল খাদ্য গ্রহণ করুন। সেহির না খেয়ে কোনো অবস্থাতেই রোজা রাখা উচিত নয়।

হাঁটা ও ব্যায়াম:

রোজাদার ডায়াবেটিস রোগীর সারাদিন স্বাভাবিক কাজকর্ম ও চলাফেরা করতে কোন বাধা নেই। রোজা রেখে দিনের বেলা অতিরিক্ত পরিশ্রম ও ব্যায়াম না করাই ভালো। এতে রক্তে সুগার হঠাৎ কমে যেতে পারে এবং অতিরিক্ত ঘাম হওয়ার কারণে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। বিশেষ করে ইফতারের কয়েক ঘন্টা আগে। তাই, যোহরের নামাজের পর থেকে ইফতারের আগে পর্যন্ত অধিক কায়িক পরিশ্রম বা ব্যায়াম না করাই ভালো। নিয়মিত তারাবী নামাজ ডায়াবেটিস রোগীর জন্য সারাদিনের হাঁটা ও ব্যায়ামের মতো কাজ করবে। আলাদা করে ব্যায়ামের প্রয়োজন নেই। সন্ধ্যার পর হালকা ব্যায়াম বা আধা ঘণ্টা হাঁটা যেতে পারে।

রক্তের গ্লুকোজ মাপা:

বিশ্বের বড় বড় ইসলামি চিন্তাবিদ ও শাস্ত্রবিদেরা আগেই রায় দিয়েছেন যে রোজা রেখে রক্তে সুগার পরীক্ষা করালে তাতে রোজা ভেঙে যায় না। সারা দিনে কয়েকবার বাসায় গ্লুকোমিটার দিয়ে রক্তের গ্লুকোজ পরিমাপ করুন। যাতে গ্লুকোজের মাত্রা খুব বেশী কমে গেলে বা বেড়ে গেলে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা গ্রহন করা যায়।

অন্তত সপ্তাহে এক বা দুই দিন সেহিরর দুই ঘণ্টা পর এবং ইফতারির অন্তত আধা ঘণ্টা আগে সুগার মাপুন। সেহিরর পর সুগার আট মিলিমোল বা এর কম এবং ইফতারির আগে ছয় মিলিমোল বা এর কম থাকা বাঞ্ছনীয়। এর মধ্যে দিনের যেকোনো সময় খারাপ লাগলে বা শরীর কাঁপলে, ঘেমে উঠলে, মাথা ফাঁকা লাগলে অবশ্যই সুগার মাপুন।

রোজা ভাঙ্গা:

দিনের যেকোনো সময়ে সুগার ৩ দশমিক ৩ মিলিমোল বা তার কম এবং দিনের পূর্বাহ্নেই ৩ দশমিক ৯ মিলিমোল বা তার কম হয়ে গেলে সেদিন রোজা ভেঙে ফেলতে হবে। দিনের যেকোনো সময় রক্তে সুগার ১৬ মিলিমোলের বেশি হয়ে গেলেও রোজা ভাঙতে হবে। ঘন ঘন বমি বা পাতলা পায়খানা হলে বা অসুস্থতার সময় রোজা না রাখাই উচিৎ।

ওষুধ ও ইনসুলিনের মাত্রা ও সময় জেনে নিন:

রোজা পালনরত অবস্থায় চামড়ার নিচে ইনসুলিন গ্রহণ করা জায়েজ বলে দেশের ও মুসলিম বিশ্বের আলেমরা মত দিয়েছেন।

রোজায় খাবারের সময়সূচি পরিবর্তনের সঙ্গে ওষুধ এবং ইনসুলিনের সময় ও মাত্রা অবশ্যই পরিবর্তিত হবে। সকালের ওষুধ বা ইনসুলিন পূর্ণ মাত্রায় সন্ধ্যাবেলা ও রাতের ওষুধ বা ইনসুলিন অর্ধেক মাত্রায় শেষ রাতে ব্যবহার করা হয়। তবে এটি রক্তে শর্করার পরিমাণের ওপর নির্ভর করবে। তাই নিজে পরিবর্তন না করে চিকিত্সকের পরামর্শ নেওয়াই ভালো। সম্ভব হলে আধুনিক, দীর্ঘস্থায়ী ইনসুলিন (গ্লারজিন ও ডেটেমির) এবং যেসব মুখে খাওয়ার ওষুধ রমজানে বিশেষ উপযোগী (গি্লক্লাজাইড এমআর, গি্লমেপেরাইড) সেগুলোর ব্যবহার করতে পারেন।

ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মূলমন্ত্র সুশৃঙ্খল জীবনপদ্ধতি। সঠিক নির্দেশনা অনুযায়ী সিয়াম সাধনা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের একটি উত্তম সুযোগ। এতে রক্তে গ্লুকোজ ও চর্বির পরিমাণ হ্রাস পায় এবং ওজন কমানোর ক্ষেত্রেও এর প্রভাব দেখা যায়।