শিশুর জন্য মায়ের দুধ

শেয়ার করুন

সুচিপত্র

মায়ের দুধ শিশুর জীবনধারণ এবং পুষ্টি ও বৃদ্ধির জন্য একটি উৎকৃষ্ট সুষম খাদ্য।  জন্মের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব (আধা ঘন্টার মধ্যেই শিশুকে মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে। পূর্ণ ৬ মাস (১৮০ দিন) পর্যন্ত শিশুকে শুধু মাত্র (১ ফোঁটা পানিও না) মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে। এরপর পরিপূরক খাবারের পাশাপাশি ২ বছর পর্যন্ত শিশুকে মায়ের দুধ খাইয়ে যেতে হবে।

শাল দুধের উপকারিতা

প্রসবের পরে মায়ের বুকে প্রথম যে দুধ আসে তাকে শালদুধ বলে। শালদুধ ঘন, আঁঠালো এবং একটু হলুদ রংয়ের হয়ে থাকে। শিশুকে শাল দুধ খাওয়ানোর উপকারিতা গুলো হলো:

(১) শালদুধ শিশুর জন্য অত্যন্ত উপকারী এবং শিশুর জীবনের প্রথম টিকা হিসাবে কাজ করে ।

(২) শালদুধ আমিষ সমৃদ্ধ এবং এতে প্রচুর ভিটামিন-এ আছে।

(৩) এতে আছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ।

(৪) শালদুধ শিশুর পেট পরিষ্কার করে এবং নিয়মিত পায়খানা হতে সাহায্য করে।

(৫) শিশুর জন্ডিস হবার সম্ভাবনা কমে যায় ।

প্রসবের পরে প্রথম ২-৩ দিন যতটুকু শালদুধ আসে তাই নবজাতকের জন্য যথেষ্ট। এসময় শিশুকে পানি, মধু বা চিনির পানি দেওয়া শিশুর জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এসব দিলে পাতলা পায়খানা হবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। অন্যদিকে শিশুর বুকের দুধ খাবার আগ্রহ কমে যায়।

মায়ের দুধের উপকারিতা

ক. শিশুর উপকার

(১) মায়ের দুধে শিশুর জন্য প্রয়োজনীয় সকল পুষ্টি উপাদান সঠিক মাত্রায় থাকে। ৫ মাস বয়স পর্যন্ত শুধুমাত্র বুকের দুধই শিশুর জন্য যথেষ্ট । মায়ের দুধে পুষ্টি উপাদান ছাড়াও আছে শতকরা ৯০ ভাগ পানি। সেইজন্য শিশুকে ৫ মাস বয়স পর্যন্ত আলাদা পানি দেবার প্রয়োজন নেই।

(২) মায়ের বুকের দুধ পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত। বায়ু বা পানি বাহিত জীবানু দ্বারা সংক্রমিত হবার সুযোগ নেই। উপরন্ত মায়ের দুধে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা জন্মায়-যার ফলে শিশুর অসুখ বিসুখ বিশেষ করে ডায়রিয়া, কানপাকা, নিউমোনিয়া, শ্বাসনালীর রোগ, হাঁপানী, এলার্জি,  চুলকানি ইত্যাদি কম হয়।

(৩) মায়ের দুধে শিশুর  বুদ্ধি বাড়ে। তাছাড়া স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটে।

(৪) অসুখ হলেও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশী থাকার কারণে শিশু তাড়াতাড়ি ভাল হয়ে যায়।

(৫) মায়ের দুধ শিশু মৃত্যুর হার কমায়।

(৬) মায়ের দুধ সহজে হজম হয় ।

(৭) মায়ের দুধে পূর্ণমাত্রায় ভিটামিন ‘এ’ থাকে বলে শিশুর রাতকানা হবার সম্ভাবনা থাকে না।

(৮) এছাড়া পরবর্তীতে শিশুর ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ ইত্যাদি ভয়াবহ রোগ হাবর সম্ভবনা কমে যায়।

খ. মায়ের উপকার

(১) জম্মের সাথে সাথে শিশুকে বুকের দুধ দিলে মায়ের প্রসবজনিত রক্তপাত বন্ধ হয। পরবর্তীতে রক্তস্বল্পতা হয় না। মায়ের গর্ভফুল পড়তে সাহায্য করে, জরায়ু তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।

(২) মায়ের স্বাস্থ্য ভাল থাকে।

(৩) যে সব মা শিশুদের বুকের দুধ খাওয়ান তাদের স্তন, জরায়ু এবং ডিম্বকোষের ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা কম থাকে।

(৪) ৫ মাস বয়স পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ালে স্বাভাবিকভাবে জন্মনিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে এবং ২ বৎসর বয়স পর্যন্ত বুকের দুধ খাওয়ালে ঘন ঘন গর্ভবতী হবার সম্ভাবনা কমে যায়।

(৫) মায়ের দুধ খাওয়ালে মায়ের আত্নবিশ্বাস বাড়ে।

(৬) মায়ের দুধ খাওয়ালে মা ও শিশুর মধ্যে সম্পর্ক নিবিড় হয়।

(৭) মায়ের দুধ নিরাপদ, ঝামেলামুক্ত এবং মায়ের বাড়তি খাটুনি ও সময় বাঁচায় এবং অর্থের সাশ্রয় হয়।

(৮) রাতে শিশু মায়ের কাছে শোয়া থাকে বলে মা শিশুকে যখন খুশী তখন শুয়ে শুয়ে খাওয়াতে পারেন।

গ. পরিবারের জন্য উপকার

(১) মায়ের দুধ খাওয়ালে শিশুর জন্য বাড়তি দুধ, দুধ খাওয়ার জন্য সরঞ্জাম যেমন বোতল, নিপল ইত্যাদি কেনার খরচ, বাড়তি পরিষ্কারের জন্য বিশুদ্ধ পানি এবং জ্বালানী ইত্যাদির খরচ বাঁচে।

(২) শিশুর রোগ কম হয় বলে চিকিৎসা খরচ যেমন ঔষধ, ডাক্তার এবং হাসপাতালে ভর্তির খরচ বাঁচে।

বুকের দুধ চেপে বের করে খাওয়ানো

হাতের সাহায্যে বুকের দুধ গেলে বের করার পদ্ধতি

  • সাবান দিয়ে ভালো করে হাত ধুয়ে,পরিষ্কার বড় মুখের একটি পাত্র নিয়ে বসতে হবে
  • হাতের বুড়ো আঙ্গুল স্তনের বোঁটার উপরে কালো চামড়ায় এবং তর্জনী বোটার নীচে কালো চামড়ায় রাখতে হবে, অন্যান্য আঙ্গুল দিয়ে স্তনকে সাপোর্ট দিতে হবে
  • বোটার পিছনে কালোচামড়ায় চাপ দিতে হবে। পর্যায়ক্রমে হাল্কাভাবে চাপতে ও ছাড়তে হবে। কোনভাবেই জোরে চাপা যাবে না
  • কালো চামড়ায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারপাশে চাপতে হবে। আঙ্গুল কিছুতেই চামড়াতে ঘষা যাবে না। এক স্তনে কমপক্ষে ৩-৫ মিনিট চাপতে হবে অত:পর অন্য স্তনে চাপতে হবে। এভাবে পুনরাবৃত্তি করতে হবে। বিশেষ করে প্রথমে কিছুদিন পর্যাপ্ত বুকের দুধ পেতে ২০-৩০ মিনিট ধরে চাপতে হবে।

গালা দুধ শিশুকে খাওয়ানোর নিয়ম

  • চেপে বের করা দুধ অবশ্যই কাপে/গ্লাসে করে শিশুকে খাওয়াতে হবে।
  • সাধারণ তাপমাত্রায় এই দুধ ৬-৮ ঘন্টা এবং ফ্রিজে ২৪ ঘন্টা পর্যন্ত রাখা যায়।
  • শিশুকে খাওয়ানোর পূর্বে দুধের পাত্র ঝাঁকিয়ে নিতে হবে। কেননা দুধ কিছুক্ষণ রেখে দিলে উপরে চর্বি ভাসতে থাকে।

শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সঠিক পদ্ধতি

  • মা তার শিশুকে আরামদায়ক অবস্থানে শুয়ে বা বসে দুধ খাওয়াবেন। শুয়ে খাওয়ালে কাত হয়ে এবং বসে খাওয়ালে এমনভাবে বসতে হবে যাতে মেরুদন্ড সোজা থাকে। অর্থাৎ কোমর বাঁকা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
  • দুধ খাওয়ানোর সময় শিশুকে মায়ের দিকে পুরোপুরি ঘুরিয়ে নিতে হবে যাতে শিশুর বুক ও পেট মায়ের বুক ও পেটের দিকে ফেরানো থাকে এবং শিশুর ঘাড়, পিঠ এবং পাছা যেন একটি সরল রেখায় থাকে অর্থাৎ শিশুকে যাতে ঘাড় বাঁকা  করে দুধ চুষতে না হয়। এভাবে না খাওয়ালে শিশুটি বুকের দুধের সঠিক স্থান ধরে চুষে সম্পূর্ণ দুধটুকু পেটভরে খেতে পারে না।
  • মা শিশুকে সঠিক অবস্থানে রেখে স্তনের বোঁটা শিশুর উপরের ঠোঁটে কয়েকবার লাগাবেন-এতে শিশুটি হা করে মুখ খুলেবে। শিশু বড় করে হা করলেই শিশুকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বোঁটাসহ বোঁটার পেছনের কালো অংশের বেশীরভাগ শিশুর মুখে দেওয়াতে হবে। কেননা বোঁটার পেছনের কালো অংশের মধ্যেই দুধ জমা থাকে। এভাবে দুধ খাওয়ালে শিশুটি দুধ পাবে। শুধু বোঁটা মুখে দিয়ে চুষলে শিশু দুধ পাবে না এবং মা বোঁটায় আঘাত পাবেন।

শিশুকে বিকল্প দুধ খাওয়ানোর অপকারিতা

শিশুর জন্য মায়ের দুধ ছাড়া অন্য কোন প্রাণী যেমন গরু, ছাগল ইত্যাদির দুধ অথবা টিনের দুধ ব্যবহার করলে তাকে আমরা বিকল্প দুধ বলে থাকি। নিম্নে শিশুকে বিকল্প দুধ খাওয়ানোর কতিপয় অপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করা হলোঃ

  • বিকল্প দুধে সবসময়ই রোগজীবানু বহন করার ভয় থাকে। দুধ, নিপল এবং বোতলের সাথে অথবা বিকল্প দুধ তৈরীতে ব্যবহৃত পানির সাথে রোগজীবাণু থাকার সম্ভাবনা রয়ে যায়। তাই শিশুর ঘন ঘন অসুখ হয়।
  • গরমের সময় দুধের বোতল, দুধসহ কিছুক্ষণ থাকলে তাতে খুব তাড়াতাড়ি রোগজীবাণু জন্মায়। পক্ষান্তরে মায়ের দুধ  সবমসয়ই বিশুদ্ধ।
  • বিকল্প দুধের ফলে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক কম থাকে। শিশুর ডায়রিয়াসহ অন্যান্য রোগ-ব্যাধির ঝুঁকি বেড়ে যায়। পরিণামে তারা অপুষ্টি ও মৃত্যুর শিকার হয়।
  • বিকল্প দুধে লৌহ জাতীয় (আয়রণ) পর্দাথের অভাব থাকে বলে শিশু রক্তস্বল্পতায় ভোগে এবং মানসিক ও বুদ্ধিভিত্তিক বৃদ্ধি বিঘ্নিত হয়।
  • শিশুকে গরুর দুধ খাওয়ালে, বিশেষ করে শিশুর যখন পাতলা পায়খানা হয় তখন তার খিচুনী হতে পারে।
  • গরুর দুধ শিশুদের সহজে হজম হয় না। শিশু প্রায়ই কোষ্ঠকাঠিন্যতে কষ্ট পায়।
  • বোতলের দুধে মায়ের খাটুনী ও খরচ বাড়ে।
  • বোতলে দুধ খেলে শিশু ধীরে ধীরে মায়ের দুধ খাওয়া কমিয়ে দেয়। বোতলের বোঁটায় অনেক বড় ফুটা থাকে বলে শিশু অনায়াসে দুধ পায়। তাই শিশু কষ্ট করে মায়ের দুধ খেতে চায় না। ফলে বুকের দুধ ক্রমে শুকিয়ে যায়।
  • সঠিক নিয়মে টিনের দুধ খাওয়াতে গেলে মাসে প্রচুর টাকা লাগে। বাংলাদেশে খুব কম পরিবারের পক্ষেই এই ব্যয় ভার বহন করা সম্ভব ।

শিশুকে বারে বারে দিনে রাতে ৮-১২ বার মায়ের দুধ খাওয়ান। শিশুর চাহিদা অনুযায়ী তাকে মায়ের দুধ খেতে দিন। রাতে অবশ্যই মায়ের দুধ খাওয়াবেন।

শাল দুধ কাকে বলে?

প্রসবের পরে মায়ের বুকে প্রথম যে দুধ আসে তাকে শালদুধ বলে। শালদুধ ঘন, আঁঠালো এবং একটু হলুদ রংয়ের হয়ে থাকে।

শিশুকে শাল দুধ খাওয়ানোর উপকারিতা গুলো কি কি?

শিশুকে শাল দুধ খাওয়ানোর উপকারিতা গুলো হলো:

(১) শালদুধ শিশুর জন্য অত্যন্ত উপকারী এবং শিশুর জীবনের প্রথম টিকা হিসাবে কাজ করে ।

(২) শালদুধ আমিষ সমৃদ্ধ এবং এতে প্রচুর ভিটামিন-এ আছে।

(৩) এতে আছে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ।

(৪) শালদুধ শিশুর পেট পরিষ্কার করে এবং নিয়মিত পায়খানা হতে সাহায্য করে।

(৫) শিশুর জন্ডিস হবার সম্ভাবনা কমে যায় ।

মায়ের দুধে পানির পরিমাণ কতটুকু থাকে?

মায়ের দুধে পুষ্টি উপাদান ছাড়াও আছে শতকরা ৯০ ভাগ পানি। সেইজন্য শিশুকে ৫ মাস বয়স পর্যন্ত আলাদা পানি দেবার প্রয়োজন নেই।

শিশুকে দিনে ও রাতে কতবার বুকের দুধ খাওয়ানো উচিৎ?

শিশুকে বারে বারে দিনে রাতে ৮-১২ বার বুকের দুধ খাওয়াতে হবে।

শিশুকে কতদিন পর্যন্ত মায়ের দুধ খাওয়ানো চালিয়ে যেতে হবে?

পূর্ণ ৬ মাস (১৮০ দিন) পর্যন্ত শিশুকে শুধু মাত্র (১ ফোঁটা পানিও না) মায়ের দুধ খাওয়াতে হবে। এরপর পরিপূরক খাবারের পাশাপাশি ২ বছর পর্যন্ত শিশুকে মায়ের দুধ খাইয়ে যেতে হবে।