হাইপারটেনশনের লক্ষণ

শেয়ার করুন

সুচিপত্র

যখন কোন ব্যাক্তির রক্তের চাপ সব সময়েই স্বাভাবিকের চেয়ে ঊর্ধ্বে থাকে তখন তাকে হাইপারটেনশন (Hypertension) বা উচ্চ রক্তচাপ বলে। এমন কোনও সুনির্দিষ্ট বিন্দু নেই যখন থেকে রক্তচাপকে উচ্চ বলে বিবেচনা করা হয়। হাইপারটেনশনকে সাধারনভাবে প্রাথমিক (আবশ্যিক) হাইপারটেনশন এবং গৌণ হাইপারটেনশন এ দুই শ্রেণীতে ভাগ করা হয়। শতকরা প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ হ্মেত্রেই প্রাথমিক হাইপারটেনশন হয়। উচ্চ রক্ত চাপের নির্দিষ্ট করে কোন কারণ এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

উচ্চ রক্তচাপ একটি নীরব ঘাতক। অনেকের ক্ষেত্রে এই রোগ খুব সহজে ধরা পড়ে না আবার ধরা পড়ার পর এর সঠিক চিকিৎসা গ্রহণ না করলে ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রণে না থাকলে তা অনেক রোগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। পৃথিবীতে ২৫ বছরের উর্ধে জনসংখ্যার প্রায় শতকরা ৪০ ভাগ উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত। সারা বিশ্বে প্রতি বছর ১৭.৩ মিলিয়ন মানুষ উচ্চ রক্তচাপ অথবা উচ্চ রক্তচাপ সম্পর্কিত জটিলতায় মৃত্যু বরণ করেন।

সাধারনভাবে বলা হয়, যদি কোনও ব্যক্তির উভয় বাহুতে রক্তচাপ ১৪০/৯০ টর (টর চাপের একটি একক) অথবা এর উপরে থাকে, তাহলে সেটাকে উচ্চ রক্ত চাপ বলা যেতে পারে। আবার রক্তচাপ ১৩৯/৮৯ টর থেকে ১২০/৮০ টর হলে সেটাকে প্রিহাইপারটেনশন বলা হয়। প্রিহাইপারটেনশন কোন রোগ নয়, কিন্তু প্রিহাইপারটেনশন আছে এমন ব্যক্তির উচ্চড়ক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশী থাকে। আবার, ডায়াবেটিস অথবা কিডনী রোগীদের ক্ষেত্রে, ১৩০/৮০ টরের অধিক রক্তচাপ হলেই সাবধান হতে হবে এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে প্রয়োজনে চিকিৎসা শুরু করতে হবে।

উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ

  • অস্বস্তি বোধ করা
  • নিয়মিত বা অতিরিক্ত মাথা ব্যথা
  • ঘাড়ে ব্যথা
  • চোখে ঝাপসা দেখা

উচ্চ রক্তচাপের কারণ

সাধারনভাবে নিম্নলিখিত কারনে উচ্চ রক্তচাপ হয়ে থাকেঃ

  • অতিরিক্ত কাজের চাপ
  • অতিরিক্ত মদ্যপান
  • উচ্চমাত্রার লবণের ব্যবহারের
  • মেদ
  • পরিবারের আকার বড় হওয়া
  • বেশী আওয়াজ
  • ঘিঞ্জি পরিবেশ
  • গর্ভধারণের কারণে

উচ্চমাত্রার লবণের ব্যবহারের কারনে প্রায় শতকরা ৬০ ভাগ রোগী এই রোগে আক্রান্ত হন। উত্তরাধিকার সূত্রে উচ্চ রক্তচাপ একটি স্বাভাবিক ঘটনা। সাধারণত শতকরা ১০ ভাগ পর্যন্ত মহিলা গর্ভধারণের কারণে উচ্চ রক্তচাপের স্বীকার হন। বৃক্কের উচ্চড়ক্তচাপ সাধারণত বৃক্কজনিত অসুস্থতার কারণে ঘটে থাকে।

কিভাবে বুঝবেন আপনি হাইপারটেনশনে আক্রান্ত?

সাধারনভাবে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশী রক্তচাপ হলেই ধরে নেয়া হয় সে হাইপারটেনশনে আক্রান্ত। স্বাধারণত এক সপ্তাহের বিরতিতে কমপক্ষে তিনবার মাপতে হবে। সঠিক চাপ নির্ণয়ের জন্য কয়েকটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে যেমন- দুশ্চিন্তামুক্ত অবস্থায় মাপতে হবে, কমপক্ষে পাঁচ মিনিট সময় বসা অবস্থায় থাকতে হবে, রক্তচাপ মাপার কমপক্ষে আধা ঘন্টা আগে থেকে ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে, মাদক গ্রহণের কমপক্ষে একঘন্টা পরে মাপতে হবে।

উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা বা নিয়ন্ত্রনের উপায়

সাধারনভাবে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের রক্তচাপের জন্য চিকিৎসকেরা ওজন কমানো এবং নিয়মিত ব্যায়ামকেই চিকিৎসার প্রথম ধাপ হিসেবে বিবেচনা করেন। এই পদ্ধতিগুলি রক্তচাপ কমানোর জন্য অত্যন্ত ফলপ্রসু, কিন্তু এগুলো সবাই ঠিকমতো মেনে চলতে পারেন না। বেশিরভাগ রোগীর ক্ষেত্রেই, মাঝারী থেকে উচ্চ রক্তচাপে যারা ভূগছেন, তারা অনির্দিষ্টকালের জন্য ঔষধের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।

উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীর রক্তচাপ কমাতে নিম্নমাত্রায় লবণ, ফল, শাক সব্জি, স্নেহ বিহীন দুগ্ধজাত খাদ্য ও তেল কম খাওয়া ইত্যাদি অনেকটা সাহায্য করে।

ধূমপান ছেড়ে দেয়া সরাসরি রক্তচাপ না কমালেও, উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীর জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর ফলে উচ্চ রক্তচাপের বেশকিছু উপসর্গ যেমন- স্ট্রোক অথবা হার্ট-এটাক নিয়ন্ত্রণে আসে। উচ্চরক্তচাপ মৃদু হলে সেটা সাধারণত খাদ্য নিয়ন্ত্রণ, ব্যায়াম এবং শারিরীক সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রন করা যায়।

এছাড়াও, পরিবেশগত চাপ যেমন উঁচু মাত্রার শব্দ, অতিরিক্ত আলো বা ঘিঞ্চি পরিবেশ ইত্যাদি পরিহার করলেও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য সেটা খুব উপকারী হতে পারে।

অকারন দুশ্চিন্তা রক্ত চাপ বাড়ায় তাই জীবনের যে সকল ঘটনাবলী মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে তা নিয়ে অহেতুক দুশ্চিন্তা না করে যার যার ধর্ম মতে প্রার্থনায় মনোনিবেশ করলেই দুশ্চিন্তা কমে আসবে।

যাদের উচ্চ রক্ত চাপ আছে তাদের নিয়মিত রক্তচাপ মাপা এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী সঠিক মাত্রার ঔষধ সেবন করা উচিত। অনেকে ঔষধ গ্রহনের পর রক্ত চাপ স্বাভাবিক হলেই হঠাৎ ঔষধ গ্রহণ বন্ধ করে দেয় যেটা কোনভাবেই উচিত নয়। এতে স্ট্রোকের ঝুঁকি শতকরা ২০ থেকে ৪০ ভাগ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। উচ্চ রক্ত চাপের রোগীদের অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ঔষধ বন্ধ করা কিংবা ঔষধের মাত্রা বাড়ানো কমানো ইত্যাদি করা যাবে না। পরিমিত মাত্রার ঔষধ সেবনে উচ্চ রক্তচাপ সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগী অনেক সময় জেনেও নিজের রোগ চেপে রাখেন, এটা কোনভাবেই উচিত নয়। কারন এতে রোগীর জীবনের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায় এবং বড় ধরণের কোন অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

যদিও উচ্চ রক্তচাপ আলাদাভাবে কোন অসুস্থতা নয়, কিন্তু এর চিকিৎসা করা খুবই জরুরি কারণ শরীরের অন্যান্য অঙ্গের ওপর এর স্বল্প থেকে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব পড়তে পারে। বিশেষভাবে, স্ট্রোক, হার্ট-ফেইলিউর, চোখের ক্ষতি এবং বৃক্কের বিকলতা ইত্যাদি নানান রোগের ঝুঁকি অনেক বৃদ্ধি পায়.

চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য হল রক্তচাপ স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসা অর্থাৎ, ১৪০/৯০ টরের নিচে কিন্তু, ডায়বেটিস বা কিডনীর রুগীদের ক্ষেত্রে তা ১৩০/৮০ টরের নিচে নিয়ে আসতে হবে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের প্রতিটি ঔষধ আলাদাভাবে সিস্টোলিক চাপ ৫ থেকে ১০ টর পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে তাই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনে একাধিক ঔষধ ব্যবহার করতে হয়।

উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীর জীবনযাত্রা বা লাইফস্টাইল

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য অবশ্যই জীবনযাত্রা বা লাইফস্টাইলে কিছু পরিবর্তন করতে হবে। শুধুমাত্র চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণই এর চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট নয়, ওষুধ গ্রহণের পাশাপাশি আরও কিছু বিষয় গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে। যেমনঃ

  • খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন
  • অতিরিক্ত ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে
  • নিয়মিত ব্যায়াম করা
  • রাতে সঠিকভাবে এবং পর্যাপ্ত ঘুম
  • ধূমপান থেকে বিরত থাকতে হবে
  • অতিরিক্ত মানসিক দুশ্চিন্তা না করা

ওপরের বিষয়গুলোর মধ্যে ডায়েটের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। সঠিক ডায়েট শুধু রক্তচাপকেই নিয়ন্ত্রণে রাখে না বরং রক্তচাপের মাধ্যমে যেসকল সমস্যা হতে পারে সেগুলো নিয়ন্ত্রনে রাখতেও সাহায্য করে।

ওজন নিয়ন্ত্রণ ও সঠিক ওজন বজায় রাখার জন্য উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীকে অবশ্যই খাদ্যের ক্যালরি যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ফ্যাট বা চর্বিজাতীয় খাদ্য, মিষ্টি, চিনি, অতিরিক্ত ভাত, আলু ইত্যাদি শর্করা জাতীয় খাবার কম খেতে হবে।

ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডসমৃদ্ধ ফ্যাটজাতীয় একটি খাবার যা ব্লাড প্রেশার কমাতে অনেক সাহায্য করে। মাছ, জলপাইয়ের তেল, ফুলকপি, বাদাম ইত্যাদিতে ওমেগা-৩ পাওয়া যায়।

চর্বিজাতীয় খাদ্য যেমন- গরুর মাংস, খাসির মাংস, মগজ, কলিজা, বড় চিংড়ির মাথা, ডিমের কুসুম, বেকারির খাদ্য, ঘি, বাটার, ভাজাপোড়া খাবার ইত্যাদি।

উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য পটাশিয়ামযুক্ত খাবার খাওয়া অনেক জরুরি। ডাবের পানি, সবজি, কলা, টমেটো, গাঢ় সবুজ শসা, সালাদ ইত্যাদি পটাশিয়ামের ভালো উৎস, যা উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীর খাদ্যতালিকায় থাকলে তা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে অনেক সাহায্য করে।

সোডিয়াম নিয়ন্ত্রণের সাহায্যে উচ্চ রক্তচাপ খুব সহজেই নিয়ন্ত্রণ করা যায়। লবণ হলো সোডিয়ামের সবচেয়ে বড় উৎস। প্রতিদিনের রান্নায় সর্বোচ্চ ৪ থেকে ৫ গ্রাম (সর্বোচ্চ ১ চা চামচ) পর্যন্ত লবণের ব্যবহার করতে হবে। খাবারের সময় আলাদাভাবে লবণের ব্যবহার পরিত্যাগ করতে হবে। চানাচুর, আচার, চিপস, পাপড় ইত্যাদি খাবারে লবন থাকে, তাই এগুলো না খাওয়াই ভাল।

তাই এ রোগ নিয়ন্ত্রণে খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি একটি বিষয়। সঠিক নিয়ম মেনে এবং সময়মতো পরিমিত খাবার উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে খুবই জরুরি।